টাইফয়েড জ্বরের লক্ষণ ও প্রতিকার

টাইফয়েড জ্বরের লক্ষণ ও প্রতিকার

বাংলাদেশে টাইফয়েড জ্বর একটি খুবই মারাত্মক পানিবাহিত রোগ। এটি ‘স্যালমোনেলা টাইফি’ নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমিত হয়। দূষিত খাবার ও পানির মাধ্যমে এই জীবাণু সাধারণত মানুষের দেহে প্রবেশ করে। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার মানুষদের মধ্যে টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে ও অন্ত্রনালীতে এই ব্যাকটেরিয়া অবস্থান করে। দূষিত খাবার ও পানি গ্রহণের মাধ্যমে এই ব্যাকটেরিয়া মানবদেহে প্রবেশ করে এবং দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে রক্তপ্রবাহে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে জ্বরসহ বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দেয়। আজ আমরা টাইফয়েড জ্বরের লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে জানবো।

টাইফয়েড জ্বর কেন হয়, কারণ কী?

টাইফয়েড একটি মারাত্মক পানিবাহিত রোগ যা দুটি প্রধান জীবাণুর সংক্রমণে হয়ে থাকে: 

১) সালমোনেলা টাইফি

সালমোনেলা টাইফি হলো একটি ধরনের ব্যাকটেরিয়া, যা টাইফয়েড জ্বরের প্রধান কারণ। এই ব্যাকটেরিয়াটি সাধারণত দূষিত খাবার বা পানির মাধ্যমে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। একবার শরীরে প্রবেশ করলে, এটি আমাদের অন্ত্র এবং রক্ত প্রবাহে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং গুরুতর সংক্রমণ সৃষ্টি করতে পারে। সালমোনেলা টাইফির সংক্রমণে যে টাইফয়েড জ্বর হয় তাকে ‘এন্টারিক ফিভার’ বলা হয়।

২) সালমোনেলা প্যারাটাইফি

সালমোনেলা প্যারাটাইফি হলো এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া যা টাইফয়েড জ্বরের মতোই একই ধরনের রোগ সৃষ্টি করে যা প্যারা টাইফয়েড জ্বর নামে পরিচিত। এই ব্যাকটেরিয়াকে সালমোনেলা টাইফির কাছের আত্মীয় বলা যায়। টাইফয়েডের মতোই, প্যারাটাইফয়েডও দূষিত খাবার ও পানি পান করার মাধ্যমে ছড়ায়। 

দুটি ব্যাকটেরিয়া একই গোত্রের হলেও, তাদের সৃষ্ট টাইফয়েড জ্বরের তীব্রতা এবং লক্ষণে কিছুটা পার্থক্য থাকতে পারে। সাধারণত প্যারাটাইফয়েড জ্বর টাইফয়েড জ্বরের তুলনায় কম তীব্র হয়। সাধারণত দূষিত পানি ও খাবার গ্রহণের মাধ্যমে এই জীবাণু দেহে প্রবেশ করে। যদি কোনো খাবার বা পানিতে টাইফয়েডের জীবাণু থাকে এবং সেই খাবার বা পানি গ্রহণ করা হয়, তাহলে এই জীবাণু মানবদেহে প্রবেশ করে সংক্রমিত করতে পারে। 

বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা বলছেন, পরিচ্ছন্নতার অভাব, অপরিষ্কার হাতে খাবার গ্রহণ, টয়লেট ব্যবহারে সতর্কতার অভাব এবং সালমোনেলা টাইফি ব্যাকটেরিয়ার বাহক এমন ব্যক্তির সঙ্গে সহবাসের ফলে টাইফয়েড দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। টাইফয়েড আক্রান্ত রোগীর পায়খানা এবং প্রস্রাবের মাধ্যমেও জীবাণু শরীর থেকে বের হয়। কোনো কারণে পানি, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা বা ওয়াটার স্যানিটারি সিস্টেমে ত্রুটি থাকলে টাইফয়েডের জীবাণু সেখানে মিশে গিয়ে রোগটি ছড়িয়ে পড়তে পারে। টাইফয়েড আক্রান্ত রোগীর পায়খানা ও প্রস্রাবের পর ভালো করে সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করা উচিত তা না হলে টাইফয়েডের জীবাণু থেকে যেতে পারে। পরে তার হাতের সংস্পর্শ বা খাবারের মাধ্যমে অন্য ব্যক্তিরাও সংক্রমিত হতে পারেন।

টাইফয়েড জ্বর কেন হয়, কারণ কী

টাইফয়েড জ্বরের লক্ষণ

টাইফয়েড জ্বরের লক্ষণগুলি সাধারণত ধীরে ধীরে দেখা দেয় এবং ব্যক্তিভেদে তা ভিন্ন হতে পারে। আসুন টাইফয়েড জ্বরের লক্ষণ জেনে নিই –

  • উচ্চ তাপমাত্রার টানা জ্বর টাইফয়েডের সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ। এক্ষেত্রে জ্বর সাধারণত ধীরে ধীরে বেড়ে যেতে পারে এবং দীর্ঘদিন থাকতে পারে। যা সাধারণত ১০২ থেকে ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত যেতে পারে।
  • টাইফয়েড জ্বরের সাথে তীব্র মাথা ব্যথা হতে পারে।
  • পেটের ডানদিকে বা পুরো পেটে ব্যথা, ফোলাভাব বা অস্বস্তি হতে পারে।
  • খাবার খাওয়ার আগ্রহ কমে যায় ও ক্রমাগত ওজন কমে যায়।
  • খাওয়ার আগ্রহ কমে যাওয়ায় কারণে জোর করে কিছু খেলে বমি হতে পারে।
  • টাইফয়েড জ্বরে ডায়রিয়া বা পেটের প্রদাহের মত সমস্যা দেখা দিতে পারে।
  • বিশেষ করে বৃদ্ধ ও বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে কিছু কিছু সময় কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
  • শরীরের বিভিন্ন জায়গায় যেমন মাসল ও জয়েন্টে ব্যথা হতে পারে।
  • জ্বর বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে প্রচণ্ডভাবে কফ ও শুষ্ক কাশি হতে পারে।
  • অবসাদ, ক্লান্তি এবং শক্তিহীনতা অনুভব করা।
  • বুক ও পেটের ওপর ছোট ছোট গোলাপি দাগ বা চামড়ায় লালচে দানা দেখা  দিতে পারে।
  • টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত রোগীর হার্ট রেট বা হৃদস্পন্দন কমে যেতে পারে।
  • টাইফয়েড জ্বর থেকে আরও কিছু শারীরিক জটিলতা দেখা যায় যেমন- নিউমোনিয়া, হেপাটাইটিস, এবং লিভারের সমস্যা।

টাইফয়েড জ্বরের লক্ষণ

কিভাবে টাইফয়েড জ্বর শনাক্ত করা হয়?

টাইফয়েড জ্বর শনাক্ত করার জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। প্রধান কিছু শনাক্তকরণ পদ্ধতি হলো:

১) রক্তের নমুনা নিয়ে কালচার করা হয়, যাতে সালমোনেলা টাইফি ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি শনাক্ত করা যায়।

২) রোগীর পায়খানা ও প্রস্রাব নমুনা পরীক্ষা করে টাইফয়েড ব্যাকটেরিয়া শনাক্ত করা হয়।

৩) বোন ম্যারো কালচার সবচেয়ে নির্ভুল পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত হয়, বিশেষ করে যদি রক্ত পরীক্ষায় ব্যাকটেরিয়া ধরা না পড়ে।

৪) উইডাল টেস্ট পরীক্ষাটি টাইফয়েড জ্বরের জন্য একটি সাধারণ পরীক্ষা। রক্তে সালমোনেলা টাইফি ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি আছে কিনা তা পরীক্ষা করা হয়। তবে এই পরীক্ষার ফলাফল সবসময় নির্ভরযোগ্য নাও হতে পারে।

৫) ডুয়োডেনাল ফ্লুইড কালচার পরীক্ষায় ডুয়োডেনাম থেকে নেওয়া তরল পদার্থে সালমোনেলা টাইফি ব্যাকটেরিয়া শনাক্ত করা হয়।

টাইফয়েড জ্বরের চিকিৎসা

রক্তে ‘সালমোনেলা টাইফি’ নামক টাইফয়েডের জীবাণু ছড়িয়ে পড়লে টাইফয়েড জ্বর হয়। তাই প্রথমে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রোগীর রক্তের কালচার পরীক্ষা করে জীবাণুর উপস্থিতি এবং কোন জীবাণু সেটি, তা শনাক্ত করতে হবে। কখনও কখনও পায়খানা ও প্রস্রাব পরীক্ষার মাধ্যমেও জীবাণু শনাক্ত করা যায়, তবে এটি দ্বিতীয় বা তৃতীয় সপ্তাহ পর ভালভাবে শনাক্ত করা যায়। তাই টাইফয়েড সনাক্ত করার জন্য রক্তের কালচার পরীক্ষা করাই উত্তম।

চিকিৎসা হিসেবে টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তিকে সঠিক অ্যান্টিবায়োটিক দিলে রোগ সেরে যায়। তবে চিন্তার বিষয় এই যে, আমাদের দেশে অ্যান্টিবায়োটিকের ইচ্ছেমত ব্যবহারের কারণে অনেকসময় টাইফয়েডের জীবাণু রেজিস্ট্যান্ট হয়ে যাচ্ছে। আবার আমাদের শরীর আর সেভাবে অ্যান্টিবডি উৎপন্ন করতে পারছে না। ফলে আমাদের শরীরে যে অ্যান্টিবায়োটিক গুলো আগে কাজ করত, সেগুলো এখন আর সেভাবে কাজ করতে পারছে না। তারপরও, রোগীর ব্লাড কালচার দেখে সেই অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়ার ৫ থেকে ৭ দিন পর জ্বর কমতে শুরু করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, রোগীকে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ ও অ্যান্টিবায়োটিক কোর্স সম্পন্ন করতে হবে করতে হবে। 

চিকিৎসার পাশাপাশি রোগীকে প্রচুর পরিমাণে তরল খাবার দেওয়া দরকার, কারণ দীর্ঘস্থায়ী জ্বর এবং ডায়রিয়ার কারণে তার শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। তীব্র পানিশূন্যতা দেখা দিলে শিরাপথে ওষুধ প্রদানের মাধ্যমে তরলজাতীয় খাবার দেওয়া যেতে পারে। টাইফয়েডের রোগীকে পুরোপুরি বিশ্রামে থাকতে হবে তবে জ্বর বেশি থাকলে পুরো শরীর ভেজা গামছা বা তোয়ালে দিয়ে মুছে দিতে হবে। জ্বর থাকাকালীন কিংবা জ্বর সেরে যাওয়ার পরও শরীরের শক্তি পুনরুদ্ধারে উচ্চ ক্যালরি সমৃদ্ধ ও আঁশজাতীয় খাবার গ্রহণ করা উচিত। প্রতিবার বাথরুম ব্যবহারের পর সাবান কিংবা হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে ভাল করে হাত ধুতে হবে।

টাইফয়েড জ্বর হলে কি কি খাওয়া উচিত তা জানতে আমাদের এই ব্লগটি পড়ুন 

টাইফয়েড জ্বরের চিকিৎসা

টাইফয়েড জ্বর প্রতিকারে করণীয়?

টাইফয়েড জ্বর একটি গুরুতর সংক্রামক রোগ। এই রোগ থেকে নিজের ও পরিবারকে বাঁচাতে কিছু সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরি। টাইফয়েড জ্বর প্রতিকারে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা উচিত:

১) টাইফয়েড একটি পানিবাহিত রোগ তাই বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। পানি ফুটিয়ে নিশ্চিত করতে হবে যেন তাতে সালমোনেলা টাইফি বা কোন জীবাণু না থাকে। এছাড়া ফিটকিরি ব্যবহার করা যায়, এতে টাইফয়েড, ডায়রিয়া, আমাশয় ও কৃমি সংক্রামন জাতীয় রোগ থেকে রেহাই পাওয়া যায়।

২) খাওয়ার আগে ও প্রতিবার বাথরুম ব্যবহারের পর সাবান কিংবা হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে ভাল করে হাত ধুতে হবে।

৩) হাঁড়িপাতিল থালাবাসন এবং ব্যবহার্য সকল জিনিসপত্র পরিষ্কার পানিতে ধুতে হবে।

৪) খাবার ভালভাবে রান্না বা সিদ্ধ করে তারপর খাওয়া উচিত। কোনভাবেই কাঁচা শাকসবজি খাওয়া যাবে না।

৫) খাবার রান্না, প্রস্তত কিংবা পরিবেশনের আগে খুব ভালভাবে হাত-মুখ ধুয়ে নিতে হবে।

৬) স্ট্রীট ফুড বা রাস্তার পাশের দোকানের খাবার খাওয়া এবং পানি পান করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

৭) সঠিক পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ব্যবহার করা এবং টয়লেট ব্যবহারের পর পরিষ্কার রাখতে হবে।

৮) ঠাণ্ডা খাবার না খেয়ে খাবার সবসময় গরম করে খাওয়া উচিৎ, এতে টাইফয়েডের জীবাণুর সংক্রামণ হতে রক্ষা পাওয়া যায়।

৯) ফল খাওয়ার আগে ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে। তাছাড়া কাঁচা ফল ভিনেগারে ৩০ মিনিট ডুবিয়ে রেখেও জীবাণুমুক্ত করা যায়।

১০) টাইফয়েড প্রতিরোধে ভ্যাকসিন নেওয়া যেতে পারে। দুই ধরনের ভ্যাকসিন পাওয়া যায়, ইনজেকশন এবং মুখে খাওয়ার ভ্যাকসিন। অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিতে হবে।

টাইফয়েড জ্বর প্রতিকারে করণীয়

টাইফয়েড জ্বর একটি গুরুতর ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ যা দূষিত খাবার বা পানি পান করার মাধ্যমে ছড়ায়। টাইফয়েড জ্বরের লক্ষণগুলির মধ্যে উচ্চ জ্বর, পেট ব্যথা, ডায়রিয়া, ক্লান্তি ইত্যাদি অন্যতম। এই রোগের নির্ণয়ের জন্য ডাক্তার রক্ত পরীক্ষা, মল পরীক্ষা ইত্যাদি করতে পারেন। টাইফয়েড জ্বরের চিকিৎসায় সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ ব্যবহার করা হয়। টাইফয়েড জ্বর প্রতিকারের জন্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, হাত ধোয়া, ফুটানো পানি পান করা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি। কোনো স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য সর্বদা একজন ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

তথ্যসুত্র

Mayo Clinic Typhoid fever – Symptoms & causes

Cleveland ClinicTyphoid Fever: Causes, Symptoms & Treatment

Penn MedicineTyphoid Fever – Symptoms, Causes and Treatment

WebMDTyphoid Fever Causes, Symptoms, Treatment and Vaccine

NHS UKTreatment – Typhoid fever

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *