মারাত্মক পানিবাহিত রোগ টাইফয়েড ‘সালমনেলা টাইফি’ ও ‘প্যারাটাইফি’ জীবাণু থেকে হয়ে থাকে। বাংলাদেশে টাইফয়েড জ্বর সব চেয়ে বেশি দেখা যায় গ্রীষ্মের শুরুতে এপ্রিল-মে মাসে। এই সময় আমরা অনেকেই গরমের দাবদাহ থেকে একটু প্রশান্তি পেতে রাস্তার পাশের কিংবা বিভিন্ন স্ট্রিট ফুড স্টল থেকে বিভিন্ন ধরনের শরবত, জুস, ও বিভিন্ন ধরনের পানীয় পান করে থাকি কিন্তু এসব পানীয় তৈরি হয় দূষিত পানি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে, আর এইসব দূষিত পানি বিভিন্ন রোগ-জীবাণুর বাহক হিসেবে কাজ করে। ফলে আমরা ডায়রিয়া, টাইফয়েড, আমাশয়, কলেরা, ও কৃমিসহ নানা ধরনের পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকি। আমাদের আগের পোস্টে টাইফয়েড জ্বরের লক্ষণ ও প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করেছিলাম, আজকের পোস্টে আমরা টাইফয়েড জ্বর কতদিন থাকে ও টাইফয়েড জ্বর ভালো করার উপায় নিয়ে আলোচনা করবো।
টাইফয়েড জ্বর কতদিন থাকে?
টাইফয়েড জ্বর চিকিৎসা শুরু করার পরও ১ সপ্তাহ থেকে ২ সপ্তাহ পর্যন্ত থাকতে পারে। তবে টাইফয়েড জ্বর কতদিন থাকবে তা রোগীর শারীরিক অবস্থা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং চিকিৎসার উপর নির্ভর করে। অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসা শুরু করার পর ৫-৭ দিনের মধ্যে জ্বর কমতে শুরু করে।
তবে সম্পূর্ণ সুস্থ হতে আরও কয়েক সপ্তাহ সময় লাগতে পারে। টাইফয়েড জ্বর থেকে দ্রুত সুস্থ হওয়ার জন্যে দ্রুত চিকিৎসা (১ম সপ্তাহ থেকে ২য় সপ্তাহ) শুরু করতে হবে অন্যথায় যদি (৩য় সপ্তাহে) চিকিৎসা শুরু করা হয় তখন সেখানে বিভিন্ন ধরনের জটিলতা দেখা যায়। টাইফয়েড জ্বর দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার কিছু কারণ নিচে দেওয়া হলো –
টাইফয়েড জ্বর দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার কারণ
১. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল তাদের শরীর টাইফয়েড জীবাণুকে দমন করতে ব্যর্থ হয়। ফলে সংক্রমণ দীর্ঘস্থায়ী হয় তাই জ্বরও দীর্ঘস্থায়ী হয়।দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কারণে অন্যান্য সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকিও বেড়ে যায় যা টাইফয়েড জ্বরকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।
২. অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টান্স
বাংলাদেশে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছা প্রয়োগের ফলে অনেক ব্যাকটেরিয়া এখন অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টান্স হয়ে উঠেছে তাই কিছু ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক এখন ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে তার কার্যকরীতা গড়ে তুলতে পারছে না। এজন্য জ্বরও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে
৩. সঠিক চিকিৎসার অভাব
যদি ভুল ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়, তাহলে সেটি টাইফয়েড জীবাণুর বিরুদ্ধে কার্যকরী নাও হতে পারে। কিংবা চিকিৎসা শুরু করতে বিলম্ব করলে টাইফয়েড রোগ সম্পূর্ণরূপে নিরাময় হয় না এবং পুনরায় সংক্রমণ হতে পারে।
৪. অপর্যাপ্ত ডোজ
ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক না খাওয়া হলে বা অর্ধেক পরিমাণে খেয়ে খাওয়া ছেড়ে দিলে টাইফয়েড জীবাণু অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে। ফলে পরবর্তীতে সেই অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধটি আর কাজ করতে পারে না, পরবর্তীতে এই জীবাণুগুলো বংশবিস্তার করে এবং সংক্রমণ আবার শুরু হয়ে যায়।
৫. জটিলতা
অনুপযুক্ত চিকিৎসার ফলে টাইফয়েড জ্বরের জটিলতা যেমন, ছিদ্রযুক্ত আলসার, রক্তক্ষরণ ইত্যাদি হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। ডায়াবেটিস, রক্তচাপ বা অন্যান্য রোগের কারণে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকলে টাইফয়েড জ্বর দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। এই জটিলতার কারণে জ্বর দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
৬. অন্যান্য সংক্রমণ
কখনো কখনো টাইফয়েড জ্বরের সাথে অন্য কোনো সংক্রমণও থাকতে পারে। অন্যান্য সংক্রমণ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয় ও টাইফয়েড জ্বরের চিকিৎসায় বাধা দিতে পারে। ফলে শরীর টাইফয়েড জীবাণুকে দমন করতে ব্যর্থ হয় এবং সংক্রমণ দীর্ঘস্থায়ী হয়ে পড়ে। এই ক্ষেত্রেও জ্বর দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
৭. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা
টাইফয়েড জ্বর থেকে সুস্থ হওয়ার জন্যে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা থাকা খুবই অত্যবশ্যকীয়। যদি পরিবেশ পরিষ্কার না থাকে, তাহলে চিকিৎসার পরেও একই ব্যক্তি বা পরিবারের অন্য সদস্যরা আবারও এই ব্যাকটেরিয়ার সংস্পর্শে আসতে পারে এবং পুনরায় সংক্রমিত হতে পারে।
যদি আপনার টাইফয়েড জ্বর দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিন। ডাক্তার আপনার শারীরিক পরীক্ষা করবেন এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন। পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে ডাক্তার আপনার জন্য উপযুক্ত চিকিৎসা নির্ধারণ করবেন।
টাইফয়েড জ্বর ভালো করার উপায়?
পরিপূর্ণ বিশ্রাম, প্রচুর পানি পান এবং চিকিৎসকের পরামর্শমতো অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের মাধ্যমে টাইফয়েড জ্বর ভালো করা যায়। টাইফয়েড জ্বর একটি মারাত্মক ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ যা সাধারণত দূষিত পানি বা খাবারের মাধ্যমে ছড়ায়। টাইফয়েড জ্বরের উপসর্গ দেখা দিলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা গ্রহণ করা এবং নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম মেনে চলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। টাইফয়েড জ্বর ভালো করার বিভিন্ন উপায় এবং সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিয়ে আমরা এখানে আলোচনা করব। আসুন টাইফয়েড জ্বর ভালো করার উপায় গুলো জেনে নিই –
১. অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসা
স্যালমোনেলা টাইফি ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকরী অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শে সঠিক অ্যান্টিবায়োটিক এবং তার ডোজ গ্রহণ করা জরুরি। অ্যান্টিবায়োটিকের পুরো কোর্স শেষ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এমনকি রোগের লক্ষণ কমে গেলেও।
২. বিশ্রাম
প্রচুর বিশ্রাম নিতে হবে, কারণ শরীরের সেরে ওঠার জন্য বিশ্রাম গুরুত্বপূর্ণ। টাইফয়েড জ্বরে শরীরের অনেক কোষ নষ্ট হয়। বিশ্রাম নেওয়ার মাধ্যমে শরীর এই কোষগুলোকে পুনর্নির্মাণ করার সুযোগ পায়। বিশ্রাম নেওয়ার ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে এবং সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে। পর্যাপ্ত বিশ্রাম না নিলে টাইফয়েড জ্বরের জটিলতা দেখা দিতে পারে, যেমন অন্ত্রে রক্তক্ষরণ বা ছিদ্র হয়ে যাওয়া।
৩. তরল খাবার
টাইফয়েড জ্বরের সময় শরীরকে হাইড্রেটেড রাখা অত্যন্ত জরুরি। জ্বর ও ডায়রিয়ার কারণে শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে পানি বের হয়ে যায়। এই ক্ষতি পূরণ করতে তরল খাবার খাওয়া অপরিহার্য। পানিশূন্যতা প্রতিরোধে প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি, ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন (ORS), ফলের রস, ডাবের পানি, এবং তরল পানীয় গ্রহণ করতে হবে। এটি শরীরে পানিশূন্যতা প্রতিরোধ করবে এবং শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করবে। তরল খাবার শরীরের পেশীকে কাজ করতে সাহায্য করে এবং শরীরে জমে থাকা বিষাক্ত পদার্থকে বের করে দেয়। কোনভাবেই চা, কফি বা কোল্ড ড্রিঙ্কস খাওয়া যাবে না এতে শরীরে পানিশূন্যতা বাড়াতে পারে।
৪. পুষ্টিকর খাবার
টাইফয়েড জ্বরের সময় শরীরকে সুস্থ করার জন্য পুষ্টিকর খাবার খাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জ্বর, ডায়রিয়া এবং বমি ভাবের কারণে শরীরের পানি ও পুষ্টি হারিয়ে যায়। এই ক্ষতি পূরণ করতে সুষম খাদ্য গ্রহণ করা জরুরি। টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত রোগীকে হালকা, সহজপাচ্য এবং পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো উচিত। ভাত, স্যুপ, দুধ, সবজি, ডিম, মাছ, পাকা কলা, আপেল এবং সবুজ শাকসবজি উপযুক্ত খাবার হতে পারে। রোগীর শরীরের শক্তি এবং পুষ্টি পুনরুদ্ধারের জন্য পর্যাপ্ত প্রোটিন এবং ক্যালরি প্রয়োজন। মশলাদার, তৈলাক্ত, এবং হজম করতে সমস্যা হয় এমন খাবার পরিহার করা উচিত।
টাইফয়েড জ্বর হলে কি কি খাওয়া উচিত তা জানতে আমাদের এই ব্লগটি পড়ুন
৫. পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যবিধি
টাইফয়েড জ্বর একটি সংক্রামক রোগ। এই রোগ থেকে সুস্থ হওয়ার জন্য শুধুমাত্র ওষুধ খাওয়াই যথেষ্ট নয়, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাও খুবই জরুরি। কারণ, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে আপনি নিজে ও পরিবারের অন্য সদস্যদের টাইফয়েড জ্বর থেকে রক্ষা করতে পারবেন। চলুন জেনে নিই কিভাবে পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন –
- খাবার খাওয়ার আগে, শৌচাগার ব্যবহারের পর এবং যেকোনো কিছু স্পর্শ করার পর সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধোয়া।
- ফুটানো পানি বা প্যাকেটজাত পানি পান করুন।
- খাবার রান্না ও পরিবেশনের আগে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিন।
- ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার করা খাবার খান।
- শৌচাগার ব্যবহারের পর ভালো করে হাত ধোয়া এবং শৌচাগার পরিষ্কার রাখুন।
- সময়মতো নখ কাটতে, গোসল করতে, ও পরিষ্কার কাপড় পরতে হবে।
- ব্যবহৃত টিস্যু ও ন্যাপকিন ডাস্টবিনে ফেলে দিন।
- যদি আপনার পরিবারে কেউ টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয় তাহলে তাকে অন্য সদস্যদের থেকে আলাদা করে রাখুন।
- পরিবারের অন্য সদস্যদের পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করুন।
৬. পুনরায় চেক-আপ ও পরীক্ষা
অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসা ও সঠিক যত্নের মাধ্যমে আপনি এই রোগ থেকে সুস্থ হতে পারবেন। তবে, সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েছেন কিনা তা নিশ্চিত করার জন্য ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী পুনরায় চেক-আপ করা এবং কিছু পরীক্ষা করা জরুরি। এটি নিশ্চিত করবে যে ব্যাকটেরিয়া সম্পূর্ণরূপে নির্মূল হয়েছে কিনা। সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসা শেষ হওয়ার ২-৪ সপ্তাহ পর পুনরায় চেক-আপ করাতে হয়। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চেক-আপের সময়সূচি নির্ধারণ করতে পারবেন।
৭. টাইফয়েড জ্বরের জটিলতা থেকে সতর্কতা
টাইফয়েড জ্বরের সাথে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে যেমন পেটে ব্যথা, রক্তপাত, বা মানসিক অবস্থা পরিবর্তন ইত্যাদি। টাইফয়েড জ্বরের সম্ভাব্য জটিলতা গুলো নিচে দেওয়া হলো –
- টাইফয়েড জীবাণু আন্ত্রিক দেয়ালে ছিদ্র সৃষ্টি করতে পারে।
- আন্ত্রিক দেয়ালে ছোট ছোট রক্তনালী ফেটে রক্তক্ষরণ হতে পারে।
- আন্ত্রিক দেয়ালে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে পেরিটোনিটিস হতে পারে।
- ক্ষেত্রবিশেষে হৃদপিণ্ডের পেশিতে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে।
- খুব কম ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের জ্বর (এনসেফালাইটিস) দেখা যায়।
- অস্থি মজ্জায় সংক্রমণ হলে রক্ত কম হওয়ার সমস্যা হতে পারে।
টাইফয়েড জ্বর ভালো করার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা এবং নিয়মিত ওষুধ গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্রাম ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ, পর্যাপ্ত পানি পান করা এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা রোগমুক্তির জন্য সহায়ক। দ্রুত সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করলে টাইফয়েড জ্বর সম্পূর্ণভাবে নিরাময় করা সম্ভব। সুতরাং, টাইফয়েডের কোনো লক্ষণ দেখা দিলে অবিলম্বে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত।
তথ্যসুত্রঃ
Cleveland Clinic – Typhoid Fever: Causes, Symptoms & Treatment
Redcliffe Labs – Typhoid Fever: it’s Stages, How Long Does it Last
Metropolis – Typhoid Fever: Signs, Symptoms, Causes, Stages & How Long Does it Last?
PharmEasy – 12 Home Remedies For Typhoid!
Mayo Clinic – Typhoid fever – Diagnosis & treatment