টাইফয়েড জ্বর হলে কি কি খাওয়া উচিত

টাইফয়েড জ্বর হলে কি কি খাওয়া উচিত

টাইফয়েড জ্বর হলে ‘সালমোনেলা টাইফি’ নামক এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ, যা সাধারণত দূষিত খাবার বা পানি পানের মাধ্যমে ছড়ায়। এই ব্যাকটেরিয়া আমাদের অন্ত্রকে আক্রমণ করে, যার ফলে জ্বর, পেটে ব্যথা, মাথাব্যথা এবং অন্যান্য লক্ষণ সৃষ্টি হয়। টাইফয়েড জ্বরের লক্ষণ সাধারণত শরীরে টাইফয়েডের জীবাণু প্রবেশের ৭ থেকে ৩০ দিন এর মধ্যে দেখা যায়। প্রথমে অল্প পরিমাণ উপসর্গ দেখা গেলেও পরে তা তীব্র আকার ধারণ করে। টাইফয়েড হলে অনেকে খুব বেশী চিন্তিত হয়ে যান, তবে কিছু কিছু খাবার আর নিয়ম করে যত্ন নিলে এই জ্বর খুব দ্রুত ভাল হয়ে যায়। 

টাইফয়েডে আক্রান্ত রোগীর প্রথম বড় সমস্যা হয় মুখের অরুচি যা রোগীর খাবার খাওয়ার অনিহা বাড়িয়ে দেয়। ফলে শরীরের শক্তি কমে যায় ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এছাড়া টাইফয়েডের জীবাণু আমাদের পরিপাকতন্ত্রের কর্মক্ষমতা ব্যাহত করে যা হজমে বাধা সৃষ্টি করে। তাই টাইফয়েড জ্বর প্রতিরোধে এমন খাবার খেতে হবে যা সহজে পরিপাকযোগ্য, মুখের অরুচি কমাবে এবং শরীরের শক্তি ও কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। আগের পোস্টে আমরা টাইফয়েড জ্বরের লক্ষণ ও প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। আজকে আমরা এই পোস্টে টাইফয়েড জ্বর হলে কি কি খাওয়া উচিত ও যত্ন নিয়ে আলোচনা করবো।

টাইফয়েড জ্বর হলে কি কি খাওয়া উচিত?

টাইফয়েড জ্বর হলে প্রচুর পরিমানে বিশুদ্ধ পানি ও তরল খাবার যেমন – ডাবের পানি, স্যুপ, লেবুর শরবত, বিভিন্ন ফলের জুস খেতে হবে। জ্বরের ফলে শরীরের শক্তি কমে যায় ও পানিশূন্যতা দেখা যায়। তাই উচ্চ-প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, দুগ্ধজাত খাবার, ভিটামিন-সি ও মৌসুমি ফল খেতে হবে যা শরীরের ঘাটতি পুরন করবে। 

এসব খাবার টাইফয়েড জ্বর থাকা অবস্থায় ও জ্বর সেরে যাওয়ার পরও নিয়মিত খেতে হবে। টাইফয়েড জ্বর শরীরকে দুর্বল করে তোলে, সঠিক খাবার ই পারে আপনার শরীরে প্রয়োজনীয়  শক্তির যোগান দিয়ে শরীরকে সুস্থ করে তুলতে। আসুন টাইফয়েড জ্বরের খাবার সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিই – 

তরল খাবার

টাইফয়েড জ্বর হলে অধিকাংশ সময়ে ডায়রিয়া বা পেটের সমস্যা হয় যা শরীরে রক্তশূন্যতা কিংবা পানিশূন্যতা দেখা দেয়। শরীরের এই পানিশূন্যতা পূরণ করার জন্য তরল খাবার যেমন- ডাবের পানি, স্যুপ, লেবুর শরবত, বিভিন্ন ফলের জুস, ও বিশুদ্ধ পানি পান করা উচিত। সাধারণত তরল খাবার সহজে পরিপাকযোগ্য এবং এটি শরীরে তক্ষনাৎ শক্তি যোগায়। বিশেষভাবে ডাবের পানি পানিশূন্যতা ও ডায়রিয়া প্রতিরোধে খুবই কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। ডাবের পানিতে থাকা অ্যামাইনো অ্যাসিডডায়াটারি ফাইবার ইনসুলিনের কর্মক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। ডাবের পানিতে যে পরিমাণ পটাশিয়াম আছে, তা টাইফয়েডে আক্রান্ত রোগীর দ্রুত চিকিৎসার জন্য অত্যন্ত উপকারী।

টাইফয়েড জ্বর হলে ডাবের পানির উপকারিতা

প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার

টাইফয়েড জ্বরে শরীরের অনেক কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই সময় শরীরের ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলোকে মেরামত করার জন্য প্রচুর পরিমাণে প্রোটিনের প্রয়োজন হয়। প্রোটিন শরীরের নতুন কোষ তৈরি করতে সাহায্য করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে। তবে প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণের পূর্বে খেয়াল রাখতে হবে যেন তা সহজে পরিপাকযোগ্য হয় যেমন, দুধ, সিদ্ধ ডিম, স্যামন, টুনা, চিকেন স্যুপ, ডাল, টোফু এইসব খাবারগুলো খুবই উচ্চ-প্রোটিন সমৃদ্ধ এবং সহজে হজম হয় বলে জানা যায়।

টাইফয়েড জ্বর হলে প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারের উপকারিতা

কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবার

টাইফয়েড জ্বরে কার্বোহাইড্রেট বা শর্করাসমৃদ্ধ খাবার খাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ যা সহজে হজম হয় এবং দ্রুত শক্তি প্রদান করে। এমন কিছু খাবার হল:

১) ভাতঃ এটি সহজে হজম হয় এবং প্রচুর কার্বোহাইড্রেট সরবরাহ করে। তবে রোগীর ভাত খেতে সমস্যা হলে জাউভাত করেও খাওয়ানো যায়।

২) সিদ্ধ আলুঃ এটি কার্বোহাইড্রেটের একটি ভাল উৎস যা শক্তি প্রদান করে।

৩) সুজি বা সেমাইঃ সেমাই-সুজি হালকা ও সহজে হজমযোগ্য।

৪) ওটসঃ এটি সহজে হজম হয় এবং দীর্ঘক্ষণ শক্তি দেয়।

৫) আটার রুটিঃ সহজে হজমযোগ্য এবং প্রচুর কার্বোহাইড্রেট প্রদান করে।

৬) নুডুলসঃ কম পরিমানে মশলা ও সবজি সহযোগে রান্না নুডুলস হতে পারে কার্বোহাইড্রেটের আরও একটি ভালো উৎস।

টাইফয়েড জ্বর হলে কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবারের উপকারিতা

দুগ্ধ জাতীয় খাবার

টাইফয়েড জ্বরে দুগ্ধজাতীয় খাবার খাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্য প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, প্রোটিন, ভিটামিন ডি, বি১২ এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থের একটি ভালো উৎস। দুগ্ধ জাতীয় খাবার (পাস্তুরাইজড দুধ, দই, মাখন, পনির ইত্যাদি) সহজে হজম হয় এবং শরীরে প্রয়োজনীয় শক্তি যোগায় তাই টাইফয়েড জ্বর হলে এইসব খাবার খাওয়া খুবই উপযোগী। দুধের পুষ্টি উপাদান শরীরের ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলোকে মেরামত করতে সাহায্য করে, এছাড়াও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে এবং শরীরকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। টাইফয়েড জ্বরে অনেকেরই হজমের সমস্যা হয়, তাই এই ধরনের খাবার হজমের উপর চাপ কম দেয়।

টাইফয়েড জ্বর হলে দুগ্ধ জাতীয় খাবারের উপকারিতা

ক্যালরি যুক্ত খাবার

টাইফয়েড শরীরকে দুর্বল করে তোলে তাই টাইফয়েড জ্বর হলে শরীরকে শক্তি জোগান দেওয়ার জন্য ক্যালরি যুক্ত খাবার অত্যন্ত জরুরি। টাইফয়েড জ্বরের সময় শরীরে প্রচুর পুষ্টির প্রয়োজন হয়। ক্যালরি যুক্ত খাবার এই পুষ্টি সরবরাহ করে। তবে সব উচ্চ-ক্যালরি যুক্ত খাবার খাওয়া যাবে না, যেসব খাবার সহজে হজম হয় সেসব খাবার খাওয়া উচিৎ। 

ফ্রুট স্যালাড

টাইফয়েড জ্বরে ফ্রুট স্যালাড খাওয়া খুবই উপকারী। ফলফলাদিতে ভিটামিন সি, পটাশিয়াম, এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থে সমৃদ্ধ। এই পুষ্টিগুলি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে এবং দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে সহায়তা করে। প্রায় সব ফলে প্রচুর পরিমাণে পানি থাকে, যা শরীরকে হাইড্রেটেড রাখতে সাহায্য করে। টাইফয়েড জ্বরে প্রায়ই ডায়রিয়া হয়, ফলে শরীর থেকে প্রচুর পানি বের হয়ে যায়। এই ক্ষেত্রে ফল খাওয়া শরীরে পানি জোগাতে সাহায্য করে। অনেক ফলে ফাইবার থাকে, যা হজমে সাহায্য করে এবং পেটকে সুস্থ রাখে। কিছু ফল, যেমন আম, আঙ্গুর, কাঁঠাল, কামরাঙ্গা, পেটে গ্যাস বা অস্বস্তি তৈরি করতে পারে। তাই এইসব না খাওয়াই ভালো আর খেলেও খুবই কোম পরিমাণে খেতে হবে। ফ্রুট স্যালাডে দই দিয়ে খেলে এটি সহজে হজম হয় এবং শরীরকে প্রোবায়োটিক সরবরাহ করে।

টাইফয়েড জ্বর হলে ফ্রুট স্যালাডের উপকারিতা

ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ খাবার

টাইফয়েড জ্বর একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ যা শরীরকে দুর্বল করে দেয়। এই সময় শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ভিটামিন-সি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে এবং দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে সহায়তা করে। তাছাড়া ভিটামিন সি একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা শরীরকে ফ্রি-র‌্যাডিকেলের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। নিচে কিছু ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ খাবারের তালিকা দেয়া হল যা খেলে আপনার শরীর প্রয়োজনীয় ভিটামিন-সি পাবে এবং আপনার ইমিনিটি সিস্টেম শক্তিশালী করবে:

১) লেবুঃ লেবুতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি থাকে। লেবুর শরবত পান করতে পারেন বা স্যুপে লেবুর রস মিশিয়ে খেতে পারেন।

২) কমলাঃ কমলায়ও প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি থাকে। কমলা খাওয়া বা কমলার রস পান করা যেতে পারে।

৩) কালোজামঃ কালোজাম ভিটামিন সি এবং অন্যান্য পুষ্টিগুণে ভরপুর।

৪) ষ্ট্রবেরিঃ ষ্ট্রবেরি সুস্বাদু এবং ভিটামিন সি সমৃদ্ধ।

৫) কিউইঃ কিউইতে ভিটামিন সি ছাড়াও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান থাকে।

৬) পেপায়াঃ পেপায়া হজমে সাহায্য করে এবং ভিটামিন সি সমৃদ্ধ।

৭) ব্রকলিঃ ব্রকলি ভিটামিন সি ছাড়াও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থে সমৃদ্ধ।

টাইফয়েড জ্বর হলে ভিটামিন-সি এর উপকারিতা

শুকনো ফল

শুকনো ফলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, খনিজ পদার্থ এবং ফাইবার থাকে। এই পুষ্টিগুণ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে এবং টাইফয়েড জ্বরে দুর্বল হয়ে পড়া শরীরকে শক্তি জোগাতে সাহায্য করে। শুকনো ফল যেমন, কিসমিসে আয়রন ও পটাশিয়াম, খেজুরে পটাশিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম, এবং চিনাবাদামে প্রোটিন ও ভিটামিন ই প্রচুর পরিমাণে থাকে। এছাড়া আলুবোখারা হজমে সাহায্য করে এবং শরীরে পানি জোগায়। শুকনো ফল খাওয়ার আগে ভালো করে ভিজিয়ে নিন। এতে ফাইবার নরম হবে এবং হজমে সহজ হবে। একবারে বেশি পরিমাণে শুকনো ফল খাবেন না এতে বদহজম হতে পারে।

টাইফয়েড জ্বর হলে শুকনো ফল খাওয়ার উপকারিতা

ঘরোয়া খাবার

১) তুলসী পাতাঃ তুলসী পাতা অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল গুণ সম্পন্ন। তুলসী পাতার চা পান করলে জ্বর কমাতে সাহায্য করে।

২) আদাঃ আদা জ্বর কমাতে এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। আদার চা পান করতে পারেন।

৩) মধুঃ মধু শরীরকে শক্তিশালী করে এবং জ্বর কমাতে সাহায্য করে। গরম পানিতে অল্প মধু মিশিয়ে পান করতে পারেন।

৪) দইঃ দই প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ, যা পেটের ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য রক্ষা করে।

৫) হলুদ চাঃ হলুদে কারকিউমিন নামক একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে। এটি শরীরের প্রদাহ কমাতে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে।

টাইফয়েড জ্বর হলে ঘরোয়া খাবারের উপকারিতা

টাইফয়েড জ্বরের সময় খাবার গ্রহণের বিশেষ কিছু নিয়ম যা আমাদের জানা খুবই জরুরী

  • ভাজাপোড়া, তৈলাক্ত খাবার, মশলাদার খাবার এড়িয়ে চলুন। এসব খাবার হজমে সমস্যা সৃষ্টি করে।
  • সহজে হজম হয় এমন খাবার যেমন দুধ, দই, জাউভাত,  স্যুপ, ফলের রস ইত্যাদি সহজে হজমযোগ্য।
  • একবারে বেশি পরিমাণে খাবার না খেয়ে ছোট ছোট করে বারবার খাবার খাওয়া ভালো। এতে করে খাবার ঠিকঠাক হজম হবে এবং শরীরও সবসময় পুষ্টি পাবে। 
  • শরীরকে হাইড্রেটেড রাখতে প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি পান করুন।
  • ঠান্ডা খাবারের পরিবর্তে গরম খাবার খাওয়া উচিত। 
  • খাবার ভালো করে চিবিয়ে খেলে হজমে সাহায্য হয়।
  • খাবার তৈরি করার সময় ও খাওয়ার আগে হাত ভালো করে ধোয়া উচিত।
  • ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো নতুন খাবার খাওয়া উচিত নয়।

টাইফয়েড জ্বর একটি গুরুতর রোগ। সঠিক চিকিৎসার পাশাপাশি সুষম খাদ্য গ্রহণ এই রোগ থেকে সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উপরের তথ্যগুলো আপনাকে টাইফয়েড জ্বরের সময় কি খাওয়া উচিত এবং কি খাওয়া উচিত নয় তা বুঝতে সাহায্য করবে। তবে, কোনো ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যার ক্ষেত্রে সবসময় ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। 

তথ্যসূত্র

প্রথম আলোটাইফয়েড: কীভাবে বুঝবেন, কী করবেন?

HealthlineTyphoid Diet: Overview, Foods, and Benefits

PharmeasyFoods for Typhoid – What to Eat and What to Avoid?

Metropolis IndiaTyphoid Diet: Get Typhoid Diet Chart, Know The Foods to Eat & Avoid for Fast Recovery

Redcliffe LabsWhat to Eat in Typhoid for Fast Recovery?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *