ডায়াবেটিস চিরতরে নিরাময় করা যায় – এটি বাস্তব নাকি ভ্রান্ত ধারণা?
ডায়াবেটিস একটি বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সমস্যা, যেখানে বহু মানুষ আক্রান্ত। এই রোগের চিকিৎসা নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে, বিশেষ করে ডায়াবেটিস কি পুরোপুরি নিরাময় করা সম্ভব কিনা। “চিরতরে নিরাময়” কথাটি শুনতে আশাব্যঞ্জক হলেও, এর পেছনের বাস্তবতা জানা জরুরি। এই পোস্টের মাধ্যমে আপনি ওষুধ ছাড়াই ডায়াবেটিস চিরতরে নিরাময় করার প্রাকৃতিক উপায় নিয়ে অনেক বিস্তারিত জানতে পারবেন।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের বর্তমান জ্ঞান অনুযায়ী, টাইপ ১ ডায়াবেটিসকে সম্পূর্ণরূপে নিরাময় করা যায় না। তবে টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম এবং জীবনযাত্রার ইতিবাচক পরিবর্তনের মাধ্যমে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এমনকি এমন পর্যায়ও আসতে পারে যখন কোনো ওষুধ ছাড়াই রক্তে শর্করার মাত্রা স্বাভাবিক থাকে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে এই পরিস্থিতিকে “রিমিশন” বলা হয়। এর অর্থ হলো, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং জীবনशैली পরিবর্তনের মাধ্যমে টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিরা দীর্ঘ সময় ধরে ডায়াবেটিসের লক্ষণ ও ওষুধ থেকে মুক্তি পেতে পারেন। তাই ডায়াবেটিস নিরাময় নিয়ে প্রচারিত অনেক তথ্যের মধ্যে কোনটি সঠিক, তা জানা এবং ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলা খুবই জরুরী।
ডায়াবেটিসের কারণ ও প্রকারভেদ
ডায়াবেটিস প্রধানত দুই ধরনের: টাইপ ১ এবং টাইপ ২। এই দুটি ধরনের কারণ এবং শরীরে তাদের প্রভাব ভিন্ন।
টাইপ ১ ডায়াবেটিস মূলত একটি অটোইমিউন রোগ। এর মানে হলো, আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা (ইমিউন সিস্টেম) ভুল করে অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষগুলোকে ধ্বংস করে ফেলে। ফলে শরীর আর ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না। সাধারণত শিশু বা কিশোর বয়সে এই রোগ শুরু হয় এবং আক্রান্ত ব্যক্তিকে বেঁচে থাকার জন্য নিয়মিত ইনসুলিন ইনজেকশন বা পাম্পের মাধ্যমে নিতে হয়। এর প্রধান কারণ এখনো পুরোপুরি জানা যায়নি, তবে মনে করা হয় জিনগত predispositions এবং পরিবেশগত কিছু কারণ এতে ভূমিকা রাখে।
অন্যদিকে, টাইপ ২ ডায়াবেটিস সাধারণত বয়স্কদের মধ্যে বেশি দেখা যায়, তবে आजकल অল্প বয়সীদের মধ্যেও এটি দেখা যাচ্ছে। এর প্রধান কারণ হলো ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স এবং শরীরে যথেষ্ট পরিমাণে ইনসুলিন তৈরি না হওয়া। ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স মানে হলো শরীর ইনসুলিন তৈরি করা সত্ত্বেও কোষগুলো সেই ইনসুলিনকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে না, যার ফলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বাড়তে থাকে। টাইপ ২ ডায়াবেটিসের পেছনে জিনগত কারণ যেমন কাজ করে, তেমনই অতিরিক্ত ওজন, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, অস্বাস্থ্যকর খাবার এবং মানসিক চাপের মতো পরিবেশগত কারণও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স এই রোগের একটি মূল কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
প্রাকৃতিক উপায়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের বৈজ্ঞানিক উপায়সমূহ
প্রাকৃতিক উপায়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনা বহু গবেষণায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এনে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমানো ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
১। খাবার ও খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন করুন
- নিয়মিত ও সময়মতো খাবার গ্রহণঃ আমাদের শরীর একটি নির্দিষ্ট ছন্দে কাজ করে, যার মধ্যে খাবার হজম এবং শর্করার মাত্রাও অন্তর্ভুক্ত। অনিয়মিত খাবার গ্রহণ করলে রক্তে শর্করার মাত্রায় হঠাৎ পরিবর্তন আসতে পারে, যা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সমস্যা সৃষ্টি করে। নিয়মিত এবং নির্দিষ্ট সময়ে খাবার গ্রহণ করলে শরীর সেই অনুযায়ী ইনসুলিন নিঃসরণ এবং শর্করার ব্যবহার করতে পারে, ফলে রক্তে শর্করার ভারসাম্য বজায় থাকে। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত খাবার খান তাদের রক্তে শর্করার মাত্রা অনিয়মিত খাবার গ্রহণকারীদের তুলনায় স্থিতিশীল থাকে।
- আঁশযুক্ত খাবার বেশি পরিমাণে গ্রহণঃ আঁশ বা ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার যেমন শাকসবজি, ডাল, বাদাম এবং শস্য (যেমন লাল চাল, আটার রুটি, ওটস) ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত সহায়ক। এর কারণ হলো ফাইবার ধীরে ধীরে হজম হয়। ফলে খাবার থেকে গ্লুকোজ ধীরে ধীরে রক্তে মেশে এবং রক্তে শর্করার মাত্রা হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি কমে। এছাড়াও, ফাইবার হজম প্রক্রিয়াকে ধীর করে পেট ভরা রাখতে সাহায্য করে, যা অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ কমাতে সহায়ক এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চ ফাইবারযুক্ত খাবার গ্রহণ টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায় এবং যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের রক্তে শর্করার নিয়ন্ত্রণ উন্নত করে।
- কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (GI) যুক্ত খাবার নির্বাচনঃ গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (GI) হলো একটি মাপকাঠি যা নির্দেশ করে কোনো খাবার কত দ্রুত রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বাড়াতে পারে। কম GI যুক্ত খাবার (যেমন লাল চাল, ওটস, মসুর ডাল, কিছু ফল ও সবজি) ধীরে ধীরে গ্লুকোজ নিঃসরণ করে, ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা ধীরে ধীরে বাড়ে এবং স্থিতিশীল থাকে। অন্যদিকে, উচ্চ GI যুক্ত খাবার (যেমন সাদা ভাত, সাদা রুটি, মিষ্টি পানীয়) দ্রুত রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ক্ষতিকর হতে পারে। বিভিন্ন গবেষণায় কম GI যুক্ত খাবার ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলে প্রমাণিত হয়েছে।
- চিনি, মিষ্টি, কোমল পানীয়, ফাস্ট ফুড ও অতিরিক্ত চর্বি পরিহারঃ এই ধরনের খাবারগুলোতে সাধারণত উচ্চ পরিমাণে চিনি, অস্বাস্থ্যকর ফ্যাট এবং ক্যালোরি থাকে, যা রক্তে শর্করার মাত্রা দ্রুত বাড়াতে পারে এবং ওজন বৃদ্ধি করতে সহায়ক। অতিরিক্ত ওজন ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের একটি প্রধান কারণ, যা টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায় এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণকে কঠিন করে তোলে। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, চিনিযুক্ত পানীয় এবং ফাস্ট ফুড গ্রহণ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করে।
- খাবারের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ ও বারবার অল্প পরিমাণে খাওয়াঃ একবারে বেশি পরিমাণে খাবার খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা দ্রুত বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অল্প পরিমাণে খাবার বারবার খেলে এই ঝুঁকি কমানো যায় এবং রক্তে শর্করার মাত্রা স্থিতিশীল থাকে। এটি ইনসুলিনের কার্যকারিতাকেও উন্নত করতে সাহায্য করে। অনেক ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞই এই পদ্ধতি অনুসরণ করার পরামর্শ দেন এবং গবেষণায় এর ইতিবাচক প্রভাব দেখা গেছে।
২। নিয়মিত ব্যায়াম করতে পারেন
- প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিটের জন্য মাঝারি ধরনের ব্যায়াম, যেমন দ্রুত হাঁটা, সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানো অথবা হালকা দৌড়ানো ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য অত্যন্ত উপকারী। সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন এই ধরনের ব্যায়াম করা উচিত। মাঝারি মাত্রার ব্যায়াম বলতে এমন কার্যকলাপ বোঝায় যা আপনার হৃদস্পন্দন বাড়ায় এবং শ্বাস-প্রশ্বাস কিছুটা দ্রুত করে তোলে, কিন্তু আপনি তখনও কথা বলতে সক্ষম থাকেন।
- ব্যায়াম শুধু রক্তে শর্করা কমাতেই সাহায্য করে না, এটি ওজন কমাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অতিরিক্ত ওজন ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের একটি প্রধান কারণ, অর্থাৎ শরীরে ইনসুলিন তৈরি হলেও তা ভালোভাবে কাজ করতে পারে না। নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে ওজন কমলে বা নিয়ন্ত্রণে থাকলে শরীরের কোষগুলো ইনসুলিনের প্রতি আরও সংবেদনশীল হয়ে ওঠে, ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সুবিধা হয়।
৩। মানসিক চাপ ও ঘুম হতে পারে একটি কারণ
- মানসিক চাপ এবং পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ এবং ঘুমের অভাব রক্তে শর্করার মাত্রাকে বাড়িয়ে দিতে পারে এবং ইনসুলিনের কার্যকারিতাকে ব্যাহত করতে পারে।
মানসিক চাপ কমানোর জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে। মেডিটেশন বা ধ্যান একটি কার্যকরী উপায়, যা মনকে শান্ত করে এবং স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে। যোগব্যায়াম শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায় এবং স্ট্রেস হরমোন নিঃসরণ কমাতে সহায়ক। এছাড়াও, সঠিক শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম তাৎক্ষণিকভাবে মানসিক চাপ কমাতে পারে। নিয়মিত এই পদ্ধতিগুলো অনুশীলন করলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। - পর্যাপ্ত ঘুম ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য অপরিহার্য। প্রতিদিন রাতে ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো শরীরের হরমোন balance বজায় রাখতে সাহায্য করে, যার মধ্যে ইনসুলিনও অন্তর্ভুক্ত। ঘুমের অভাব শরীরে স্ট্রেস হরমোন যেমন কর্টিসলের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে, যা রক্তে শর্করার মাত্রাকে বৃদ্ধি করে। পর্যাপ্ত ঘুম শরীরকে পুনরায় সক্রিয় করে তোলে এবং ইনসুলিনের সঠিক কার্যকারিতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত পর্যাপ্ত ঘুমান, তাদের রক্তে শর্করার মাত্রা তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল থাকে।
৪। ওজন নিয়ন্ত্রণে মনোযোগ দিন
অতিরিক্ত ওজন কমাতে পারলে রক্তে শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিক হবে এবং ইনসুলিন আরও ভালোভাবে কাজ করবে। এমনকি অল্প ওজন কমালেও উপকার পাওয়া যায়।
- আপনার ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন। যদি আপনার ওজন বেশি হয়ে থাকে, তবে ধীরে ধীরে তা কমানোর চেষ্টা করুন। মনে রাখবেন, সামান্য ওজন হ্রাসও রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে এবং ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়াতে সহায়ক হতে পারে।
- সুস্থ ওজন বজায় রাখুন। অতিরিক্ত ওজন শরীরের জন্য ক্ষতিকর, বিশেষ করে রক্তে শর্করার মাত্রা এবং ইনসুলিনের কার্যকারিতার ক্ষেত্রে। তাই ধীরে ধীরে ওজন কমালে এই সমস্যাগুলো নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। এমনকি অল্প পরিমাণ ওজন কমলেও আপনি ইতিবাচক পরিবর্তন দেখতে পাবেন।
- ওয়েট ম্যানেজমেন্ট: অতিরিক্ত ওজন কমাতে পারলে ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে আসে এবং ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়ে। অল্প একটু ওজন কমালেও এর ইতিবাচক প্রভাব দেখা যায়।
৫। পর্যাপ্ত পানি পান করুন
- পর্যাপ্ত পরিমাণে জল পান করা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই জরুরি। যখন আমরা প্রচুর জল পান করি, তখন আমাদের শরীর প্রস্রাবের মাধ্যমে অতিরিক্ত চিনি বের করে দিতে পারে। এর ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হয় এবং শরীর পানিশূন্যতা থেকেও রক্ষা পায়। তাই সুস্থ থাকতে প্রতিদিন যথেষ্ট জল পান করা উচিত।
৬। নিয়মিত রক্তে শর্করা পরীক্ষা করুন
- নিয়মিতভাবে রক্তে শর্করার পরিমাণ পরীক্ষা করা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে আপনি জানতে পারবেন আপনার শরীরের শর্করার মাত্রা কেমন আছে এবং সেই অনুযায়ী খাদ্য ও ওষুধে পরিবর্তন আনা বা ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া সহজ হবে। তাই ডাক্তারের নির্দেশ অনুযায়ী নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করানো উচিত।
৭। খারাপ অভ্যাস বর্জন করুন
- ধূমপান ও মদ্যপানের মতো খারাপ অভ্যাসগুলো ত্যাগ করা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। এই অভ্যাসগুলো শুধু ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায় না, বরং যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের শরীরের শর্করার মাত্রাও নিয়ন্ত্রণ করতে বাধা দেয়। তাই সুস্থ জীবনযাপন এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে অবশ্যই ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার করা উচিত।
৮। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করুন
- পর্যাপ্ত বিশ্রাম অত্যন্ত জরুরি। আমাদের শরীর এবং মনকে পুনরায় সক্রিয় করার জন্য প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন। ঘুমের অভাব হরমোনের ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করতে পারে, যা রক্তে শর্করার মাত্রাকে প্রভাবিত করতে পারে। নিয়মিত এবং পর্যাপ্ত ঘুম ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়াতে এবং মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে।
- কর্মজীবনের ভারসাম্য বজায় রাখা প্রয়োজন। অতিরিক্ত কাজের চাপ এবং অনিয়মিত রুটিন আমাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের উপর খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে। কাজের পাশাপাশি নিজের জন্য এবং পরিবারের জন্য সময় বের করা, শখের প্রতি মনোযোগ দেওয়া এবং সামাজিক কার্যকলাপের সাথে যুক্ত থাকা মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক। মানসিক চাপ ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে, তাই একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবনযাপন এর ঝুঁকি কমায়।
- পরিবার ও চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা ডায়াবেটিস ব্যবস্থাপনার একটি অপরিহার্য অংশ। পরিবারের সমর্থন এবং সহযোগিতা রোগীকে মানসিকভাবে সাহস যোগায় এবং নিয়মকানুন মেনে চলতে উৎসাহিত করে। অন্যদিকে, একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন, খাদ্য তালিকা অনুসরণ এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো রোগের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সহায়ক। মনে রাখবেন, প্রতিটি ডায়াবেটিস রোগীর শারীরিক অবস্থা ভিন্ন, তাই ডাক্তারের ব্যক্তিগত পরামর্শ মেনে চলা সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।
- ওষুধ, খাদ্য ও ব্যায়াম—এই তিনটি বিষয় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মূল ভিত্তি। ডাক্তারের নির্দেশ অনুযায়ী সঠিক সময়ে এবং সঠিক মাত্রায় ওষুধ সেবন করা রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে অত্যাবশ্যক। এর পাশাপাশি, একটি সুষম এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্য তালিকা অনুসরণ করা জরুরি। চিনি ও মিষ্টি জাতীয় খাবার পরিহার করা, শস্য, ফল, সবজি এবং প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করা রক্তে শর্করার হঠাৎ বৃদ্ধি রোধ করতে সাহায্য করে। নিয়মিত ব্যায়াম, যেমন হাঁটা, যোগা বা অন্যান্য শারীরিক কার্যকলাপ ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়ায় এবং শরীরের অতিরিক্ত গ্লুকোজ ব্যবহার করতে সাহায্য করে। এই তিনটি বিষয়কে নিয়মিত এবং নিয়মানুবর্তিতার সাথে মেনে চললে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা অনেক সহজ হয় এবং জটিলতার ঝুঁকিও কমে যায়।
ঘরোয়া ও প্রাকৃতিক উপায়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে প্রাকৃতিক ও ঘরোয়া উপায়গুলি বহু প্রজন্ম ধরে ব্যবহার হয়ে আসছে। এগুলোর অনেকগুলোর পেছনে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও রয়েছে। নিচে ২০ টি কার্যকর উপায় বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:
করলার রস
করলা একটি পরিচিত ঔষধি গুণসম্পন্ন সবজি। এতে চ্যারান্টিন ও পলিপেপ্টাইড-পি নামক দুটি উপাদান বিদ্যমান, যা আমাদের শরীরে ইনসুলিনের মতোই কাজ করে এবং রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কমাতে সহায়ক। ডায়াবেটিসের উপকারিতা পেতে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে করলার রস পান করা যেতে পারে। নিয়মিত সেবন টাইপ ২ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
মেথি বীজ
মেথি বীজ, যা ফেনুগ্রিক নামেও পরিচিত, এতে গ্যালাক্টোম্যানান নামক একটি উপাদান থাকে। এই উপাদানটি খাবার হজম হওয়ার গতি কমিয়ে দেয়, ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি হ্রাস পায়। এছাড়াও, মেথিতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার বিদ্যমান, যা গ্লুকোজ শোষণ প্রক্রিয়াকে ধীর করে তোলে। ডায়াবেটিসের উপকারিতা লাভের জন্য রাতে এক চা চামচ মেথি পানিতে ভিজিয়ে রেখে সকালে খালি পেটে খাওয়া যেতে পারে। এটি আমাদের শরীরের ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি করে এবং রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে সাহায্য করে।
জাম পাতা
জাম পাতায় জ্যামবোলিন ও এলকালয়েড নামক দুটি বিশেষ উপাদান পাওয়া যায়, যা শর্করার রূপান্তর প্রক্রিয়াকে বাধা দেয়। এর পাশাপাশি, এটি আমাদের অগ্ন্যাশয়ের কার্যকারিতা উন্নত করতেও সহায়ক। জাম পাতা রস করে অথবা শুকনো গুঁড়ো হিসেবে খাওয়া যেতে পারে। নিয়মিত জাম পাতার রস অথবা শুকনো গুঁড়ো সেবনের মাধ্যমে টাইপ ২ ডায়াবেটিসে ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া যায়।
দারুচিনি
দারুচিনিতে সিনামালডিহাইড নামক একটি উপাদান বিদ্যমান, যা আমাদের শরীরের ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি করে। এটি গ্লুকোজ পরিবহনকারী উপাদানকে সক্রিয় করার মাধ্যমে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। উপকারিতা পেতে প্রতিদিন প্রায় আধা চা চামচ গুঁড়ো দারুচিনি খাওয়া যেতে পারে। এটি চায়ের সাথে মিশিয়ে অথবা পানিতে গুলে পান করা যায়।
আদা
আদার মধ্যে অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। এটি আমাদের শরীরের ইনসুলিন সংবেদনশীলতা উন্নত করতে সহায়ক। আদা চা পান করার মাধ্যমে অথবা কাঁচা আদা চিবিয়ে খাওয়ার মাধ্যমে এর উপকারিতা পাওয়া যায়। নিয়মিত আদা সেবন করলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
তুলসী পাতা
তুলসী পাতায় ইউজেনল, ক্যারিওফিলিন এবং মিথাইল ইউজেনল নামক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান থাকে। এই উপাদানগুলো শরীরে ইনসুলিনের নিঃসরণ বাড়াতে সাহায্য করে। ডায়াবেটিসের উপকারিতা পেতে সকালে ৪-৫টি কচি তুলসী পাতা চিবিয়ে খাওয়া যেতে পারে। এর পাশাপাশি, তুলসী পাতা আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকেও শক্তিশালী করে তোলে।
অ্যালোভেরা জেল
অ্যালোভেরাতে বেটা-সিটোস্টেরল নামক একটি উপাদান থাকে, যা আমাদের শরীরে গ্লুকোজ শোষণে সাহায্য করে। এটি অগ্ন্যাশয়কে আরও বেশি পরিমাণে ইনসুলিন উৎপাদনে উৎসাহিত করতে পারে। ডায়াবেটিসের উপকারিতা পেতে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে এক চামচ অ্যালোভেরা জেল খাওয়া যেতে পারে। এটি রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে বেশ কার্যকর।
আমলকী
আমলকীতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি এবং পলিফেনল বিদ্যমান, যা অ্যান্টি-ডায়াবেটিক বৈশিষ্ট্য সমৃদ্ধ। এটি আমাদের লিভার ও কিডনির কার্যকারিতা উন্নত করতে সহায়ক। কাঁচা আমলকীর রস পান করা অথবা আমলকীর গুঁড়ো খাওয়া যেতে পারে। এটি একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে এবং আমাদের শরীরকে বিভিন্ন ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে।
হরিতকী
হরিতকী আমাদের হজম প্রক্রিয়াকে উন্নত করে এবং অন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে। এটি ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স কমাতে ভূমিকা রাখে, যার ফলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে। রাতে ঘুমানোর আগে এক চা চামচ হরিতকীর গুঁড়ো পানির সাথে মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে। এটি কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দূর করতেও সহায়ক।
নিম পাতা
নিম পাতা একটি প্রাকৃতিক ইনসুলিন সক্রিয়কারক হিসেবে কাজ করে। এটি অ্যান্টিসেপটিক ও অ্যান্টি-ডায়াবেটিক উপাদানে পরিপূর্ণ। ডায়াবেটিসের ভালো ফলাফল পেতে সকালে খালি পেটে নিম পাতার রস খাওয়া যেতে পারে। নিয়মিত সেবন রক্তে শর্করার মাত্রাকে স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে।
কালোজিরা
কালোজিরায় থাইমোকুইনোন নামক একটি উপাদান থাকে, যা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমাতে খুবই কার্যকর। এটি অগ্ন্যাশয়ের বিটা-কোষগুলোকে সক্রিয় করে তোলে, ফলে ইনসুলিনের নিঃসরণ বৃদ্ধি পায়। কালোজিরা তেল অথবা কালোজিরার গুঁড়ো ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতেও সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
করলা চা
করলা, তুলসী, মেথি এবং আদার মিশ্রণে তৈরি একটি বিশেষ চা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত কার্যকর। প্রতিদিন এক থেকে দুই কাপ এই চা পান করা যেতে পারে। এটি আমাদের শরীরের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করে এবং ইনসুলিন সংবেদনশীলতাও বৃদ্ধি করে।
গোলমরিচ ও হলুদের মিশ্রণ
হলুদে কুরকুমিন নামক একটি উপাদান বিদ্যমান, যা অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য সমৃদ্ধ। গোলমরিচ এই কুরকুমিনের শোষণ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। রাতে হালকা গরম দুধের সাথে এই মিশ্রণ মিশিয়ে পান করা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। এটি শরীরে ইনসুলিনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে।
বেল পাতা
বেল পাতায় এমন কিছু উপাদান রয়েছে যা অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন নিঃসরণকে উৎসাহিত করে। ডায়াবেটিসের উপকারিতা পেতে সকালে দুই থেকে তিনটি কচি বেল পাতা চিবিয়ে খাওয়া যেতে পারে। এটি রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং পেট পরিষ্কার রাখতেও সহায়ক।
তরমুজের বীজ
তরমুজের বীজে ফাইবার, ম্যাগনেসিয়াম এবং জিঙ্কের মতো প্রয়োজনীয় উপাদান বিদ্যমান। এই উপাদানগুলো শরীরে ইনসুলিনের কার্যকারিতাকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। তরমুজের বীজ শুকিয়ে গুঁড়ো করে প্রতিদিন এক চা চামচ খাওয়া যেতে পারে। এটি রক্তে শর্করার মাত্রা স্থিতিশীল রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
চর্বিযুক্ত মাছ
স্যামন, সারডিন ও ম্যাকেরেলের মতো ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ মাছ আমাদের শরীরে ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করে। এটি শরীরের প্রদাহ কমায় এবং হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করে, যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার চর্বিযুক্ত মাছ খাওয়া উপকারী হতে পারে। এটি শরীরের প্রোটিনের চাহিদাও পূরণ করে।
পনির ফুল (ইনসুলিন প্ল্যান্ট)
দক্ষিণ ভারতে “ইনসুলিন প্ল্যান্ট” নামে পরিচিত কস্টাস ইগনিয়াস নামক উদ্ভিদটি টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য বিশেষভাবে উপকারী। গবেষণায় দেখা গেছে, এই উদ্ভিদের পাতায় ইনসুলিনের মতো কার্যক্ষমতা রয়েছে। প্রতিদিন সকালে একটি পাতা চিবিয়ে খেলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমতে সাহায্য করে। এটি প্রাকৃতিক উপায়ে সুগার নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত কার্যকর।
নয়নতারা
নয়নতারা বা ভিনকা রোজা উদ্ভিদে অ্যালকালয়েড নামক উপাদান থাকে, যা গ্লুকোজের বিপাক প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে। এটি আয়ুর্বেদ ও ইউনানি চিকিৎসায় ডায়াবেটিসের চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হয়। এই উদ্ভিদের পাতা দিয়ে চা তৈরি করে পান করা যেতে পারে। তবে, অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক পরিমাণে এটি গ্রহণ করতে হবে।
গায়নূরা প্রোকাম্বেন্স (ডায়াবেটিস গাছ)
গায়নূরা প্রোকাম্বেন্স, যা “ডায়াবেটিস গাছ” বা “longevity spinach” নামেও পরিচিত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত একটি জনপ্রিয় ভেষজ। এই গাছে ফ্ল্যাভোনয়েড ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বিদ্যমান, যা ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি এবং গ্লুকোজ বিপাক নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। গবেষণায় দেখা গেছে, গায়নূরার পাতার নির্যাস টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে পারে। সাধারণত এই গাছের পাতা কাঁচা খাওয়া যায় অথবা রস করে খালি পেটে পান করা যেতে পারে।
ডুমুর
ডুমুরের পাতায় এমন কিছু উপাদান থাকে যা ইনসুলিনের কার্যকারিতায় সাহায্য করে। গবেষণায় দেখা গেছে, ডুমুর পাতার রস রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমাতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। কাঁচা ডুমুর ফলও ফাইবার সমৃদ্ধ এবং হজমে সহায়ক। এটি খালি পেটে খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিয়মিত ডায়াবেটিস পরিমাপ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। টেকনো হেলথ-এ পাবেন সেরা দামে অরিজিনাল সব ডায়াবেটিস মেশিন (গ্লুকোমিটার), এখনই দেখুন।
খাদ্যতালিকা ও জীবনযাপন পরিবর্তনের কৌশল
সতর্ক জীবনযাপন ও সুপরিকল্পিত খাদ্যাভ্যাস ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নিচে ৫টি মৌলিক কৌশল আলোচনা করা হলো:
- কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্সযুক্ত খাবার নির্বাচন করুনঃ গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (GI) হলো এমন একটি পরিমাপক যা খাবার কত দ্রুত রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়ায় তা নির্দেশ করে। কম GI খাবার ধীরে হজম হয় এবং রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ধীরে বাড়ায়। যেমন: ওটস, বাদাম, শাকসবজি, লালচাল, ছোলা, মসুর ডাল ইত্যাদি। এই খাবারগুলো ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়াতে সহায়তা করে।
- সুষম খাদ্যাভ্যাস গঠন করুনঃ প্রতিটি খাবারে প্রোটিন, জটিল কার্বোহাইড্রেট ও স্বাস্থ্যকর ফ্যাটের সুষম অনুপাত রাখা জরুরি। উদাহরণস্বরূপ: ভাতের সঙ্গে মুগ ডাল ও মাছ, অথবা ওটসের সঙ্গে বাদাম ও দই। বেশি শর্করাযুক্ত ও প্রক্রিয়াজাত খাবার পরিহার করুন। ফলমূল বেছে নিতে গ্লাইসেমিক ইনডেক্স বিবেচনা করুন। যেমন: আপেল, পেয়ারা, জামরুল।
- নিয়মিত খাবার গ্রহণ ও নির্ধারিত সময়ে খাওয়াঃ অনিয়মিত খাবার রক্তে শর্করার ওঠানামা ঘটাতে পারে। তাই প্রতিদিন নির্ধারিত সময়ে খাবার গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ। বড় পরিমাণে একবারে খাবার না খেয়ে দিনে ৫–৬ বার অল্প অল্প করে খাওয়া শরীরের জন্য উপকারী।
- শরীরচর্চা ও সক্রিয় জীবনযাপনঃ ব্যায়াম ছাড়াও দৈনন্দিন কাজ যেমন সিঁড়ি ভাঙা, হেঁটে বাজার করা, বাড়ির কাজ ইত্যাদি নিয়মিতভাবে করলে মেটাবলিজম বাড়ে এবং রক্তে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে থাকে। সপ্তাহে অন্তত ৫ দিন অন্তত ৩০ মিনিট করে হাঁটা বা হালকা শরীরচর্চা করাই যথেষ্ট উপকারী।
- ঘুম ও বিশ্রামের গুরুত্বঃ প্রতিদিন রাতে পর্যাপ্ত ও নিয়মিত ঘুম রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে। ঘুমের অভাবে কর্টিসল বাড়ে, যা গ্লুকোজ লেভেল বাড়াতে পারে। দুপুরে অতিরিক্ত ঘুম বা ঘন ঘন ঘুমের অভ্যাস এড়িয়ে চলা উচিত। রাতে ৭–৮ ঘণ্টা গভীর ঘুমই আদর্শ।
ভুল ধারণা ও প্রতারণামূলক তথ্য থেকে সাবধানতা
ডায়াবেটিস সম্পর্কে সমাজে নানা ধরনের ভুল ধারণা ও প্রতারণামূলক তথ্য প্রচলিত রয়েছে, যেগুলো রোগীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। নিচে এমন পাঁচটি সাধারণ বিভ্রান্তি ও তার ব্যাখ্যা তুলে ধরা হলো:
- “৭২ ঘণ্টায় ডায়াবেটিস নিরাময়” – বাস্তবতাহীন দাবিঃ অনেক ভুয়া বিজ্ঞাপন বা অনলাইন পোস্টে দেখা যায় যে মাত্র ৩ দিনে ডায়াবেটিস নিরাময় করা সম্ভব। এই দাবি চিকিৎসাবিজ্ঞানের কোনো স্বীকৃত ভিত্তির উপর দাঁড়ায় না। ডায়াবেটিস একটি দীর্ঘমেয়াদি মেটাবলিক রোগ, যার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হলেও একে “নিরাময়” বলা ঠিক নয়।
- অলৌকিক ভেষজ বা “ম্যাজিক ওষুধ” এর প্রলোভনঃ বিভিন্ন হকার বা অনলাইন সাইটে এমন পণ্য বিক্রি হয় যা দাবি করে যে এটি খেলে একেবারে সুগার থাকবে না। বাস্তবে এসব পণ্যের অধিকাংশের কোনো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা হয়নি এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
- ইন্টারনেট থেকে চিকিৎসা – ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্তঃ অনেকেই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই গুগল সার্চ করে ডায়াবেটিসের চিকিৎসা করতে চান। অনলাইন তথ্য সবসময় রোগীর উপযোগী হয় না এবং ভুল চিকিৎসার ঝুঁকি থাকে।
- “ডায়াবেটিস শুধুই মিষ্টি খেলে হয়” – অসম্পূর্ণ ব্যাখ্যাঃ অনেকের ধারণা, শুধুমাত্র মিষ্টি বা চিনিযুক্ত খাবার খাওয়ার কারণে ডায়াবেটিস হয়। প্রকৃতপক্ষে, অতিরিক্ত ওজন, ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স, জিনগত কারণ এবং শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা ডায়াবেটিসের মূল কারণ।
- প্রাকৃতিক উপায় মানেই শতভাগ নিরাপদ – ভুল ব্যাখ্যাঃ অনেকেই মনে করেন ভেষজ বা প্রাকৃতিক চিকিৎসা মানেই কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। কিন্তু বাস্তবে অনেক ভেষজ উপাদান ওষুধের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া করতে পারে, বা অতিরিক্ত গ্রহণে শরীরে ক্ষতি করতে পারে। তাই ভেষজ উপায় ব্যবহার করার পূর্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
এই বিভ্রান্তিগুলো থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য বিশ্বস্ত উৎস থেকে তথ্য গ্রহণ, চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া এবং যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেওয়াই হলো বুদ্ধিমানের কাজ। সচেতনতা থাকলেই প্রতারণা ও ভুল ধারণা থেকে নিজেকে এবং প্রিয়জনকে রক্ষা করা সম্ভব।
চিকিৎসকের পরামর্শ ও নিয়মিত পর্যবেক্ষণের গুরুত্ব
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ এবং রক্তে গ্লুকোজ মাত্রার নিয়মিত পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিচে এ বিষয়ে ৭টি মৌলিক দিক বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:
- রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়মিত পরীক্ষাঃ প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে রক্তে শর্করার মাত্রা (যেমন সকালে না খেয়ে ও খাবারের ২ ঘণ্টা পরে) পরীক্ষা করলে শরীরের অবস্থা বোঝা যায়। এতে দ্রুত বুঝতে পারবেন কখন শর্করা বেশি বা কম হচ্ছে, এবং খাবার, ওষুধ বা ব্যায়ামের পরিমাণ ঠিকমতো আছে কিনা তা জানা যায়।
- HB1AC পরীক্ষার গুরুত্বঃ প্রতি ৩ মাসে একবার এই পরীক্ষা করালে বিগত ৩ মাসের গড় রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা জানা যায়। এটি দেখে চিকিৎসক বুঝতে পারেন, আপনার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আছে কিনা এবং ওষুধ বা খাদ্যতালিকায় পরিবর্তন দরকার কিনা।
- চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণঃ ডায়াবেটিসের ওষুধ কখন, কীভাবে এবং কত ডোজে খাবেন-এটি চিকিৎসক ঠিক করে দেন। নিজে থেকে ওষুধের ডোজ বাড়ানো বা কমানো বিপজ্জনক হতে পারে। কখন ইনসুলিন লাগবে, বা কোনো ওষুধ বন্ধ করতে হবে-এসব সিদ্ধান্ত চিকিৎসকই নিতে পারেন।
- ডায়েট প্ল্যান ও ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটির গাইডলাইনঃ প্রত্যেকের শারীরিক অবস্থা, ওজন, বয়স, অন্যান্য রোগ ভিন্ন ভিন্ন। তাই চিকিৎসক বা ডায়েটিশিয়ানের সহায়তায় ব্যক্তিগত খাদ্যতালিকা ও ব্যায়ামের রুটিন তৈরি করা উচিত। এতে ডায়াবেটিস সহজে নিয়ন্ত্রণে আসে।
- জটিলতা নিরীক্ষার জন্য নিয়মিত চেকআপঃ ডায়াবেটিস দীর্ঘমেয়াদে চোখ, কিডনি, স্নায়ু, হৃদযন্ত্র ও পায়ের নানা জটিলতা তৈরি করতে পারে। বছরে অন্তত একবার এসব অঙ্গের পরীক্ষা করানো উচিত, যাতে সমস্যা হলে দ্রুত ধরা পড়ে এবং চিকিৎসা শুরু করা যায়।
- প্রাকৃতিক ও ভেষজ উপায় ব্যবহারে চিকিৎসকের মতামতঃ অনেকে করলা, মেথি, তুলসী ইত্যাদি খেয়ে থাকেন। এসব উপাদান কখনো ওষুধের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া করতে পারে। তাই এসব কিছু শুরু করার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের অনুমতি নেওয়া দরকার।
- ইনসুলিন ব্যবহারের প্রশিক্ষণ ও মানসিক প্রস্তুতিঃ যারা ইনসুলিন নেন, তাদের ইনজেকশন দেওয়ার সঠিক নিয়ম, সংরক্ষণ ও ডোজ নিয়ন্ত্রণ জানতে হবে। চিকিৎসকের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ না নিয়ে ইনসুলিন ব্যবহার করলে বিপদ হতে পারে। তাই চিকিৎসকের নির্দেশনা ও প্রশিক্ষণ মেনে চলা জরুরি।
সচেতনতা ও ধারাবাহিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ
ডায়াবেটিস একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ, তাই একে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে একটানা চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। কেবল একটি নির্দিষ্ট পদক্ষেপ বা ক্ষণস্থায়ী প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয়। বরং, প্রতিদিনের জীবনে সচেতন থাকা এবং কিছু নিয়মকানুন মেনে চলা জরুরি। নিজের শরীরের শর্করার মাত্রা সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হবে এবং সেই অনুযায়ী খাবার, ব্যায়াম, ওষুধ ও ঘুমের বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। নিজের শরীরকে বুঝলে প্রতিদিনের সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া সহজ হয়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাময়িক ডায়েট বা ব্যায়ামের পরিবর্তে স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, নিয়মিত শরীরচর্চা করা এবং একটি নির্দিষ্ট ঘুমের রুটিন তৈরি করা দীর্ঘস্থায়ী সুফল বয়ে আনে। ভুল তথ্যের ওপর নির্ভর না করে সঠিক জ্ঞান ও ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী জীবনযাপন করা উচিত।
ডায়াবেটিস হলে হতাশ না হয়ে বরং একে স্বাভাবিক জীবনের অংশ হিসেবে মেনে নেওয়া উচিত। ইতিবাচক মানসিকতা বজায় রাখলে রোগ নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়। পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা ও সহানুভূতি এক্ষেত্রে অনেক কাজে আসে। তাদের সহায়তায় সঠিক খাবার গ্রহণ, নিয়মিত ব্যায়াম করা এবং ওষুধ খাওয়া সহজ হয়। এমনকি ভ্রমণ, উৎসব বা মানসিক চাপের সময়ও খাবারের নিয়ম, ওষুধ এবং ব্যায়াম চালিয়ে যাওয়া উচিত। ছোটখাটো ব্যতিক্রম হলেও নিয়মিত নিয়ম মেনে চলার চেষ্টা করা জরুরি।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত ছোট ছোট লক্ষ্য নির্ধারণ করা উচিত, যেমন নির্দিষ্ট মাত্রার নিচে রক্তে শর্করা রাখা বা প্রতিদিন কিছু সময় হাঁটা। সেই লক্ষ্যগুলো পূরণ হলে নিজেকে পুরস্কৃত করা বা উৎসাহিত করা উচিত। মনে রাখতে হবে, সচেতন থাকা এবং একটানা চেষ্টা চালিয়ে যাওয়াই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের প্রধান উপায়। এটি কেবল একটি রোগ নয়, বরং একটি জীবনধারা, যাকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করলে দীর্ঘকাল সুস্থ থাকা সম্ভব।